চাঁদের পাহাড়


লেখকঃ মাহমুদুল হক
রাতের আকাশে মানুষ যখনই তাকিয়েছে তখনই তার একবার চাঁদকে ছুঁয়ে দিতে ইচ্ছে হয়েছে। কী চমৎকার চাঁদ! জোছনায় এই চাঁদ আরও সুন্দর। চাঁদকে আমরা আদর করে ডাকি চাঁদমামা। ছেলেবেলায় চাঁদমামার গল্প শুনে কতবার যে শিশুরা ঘুমিয়ে পড়ে তার কোন গোনাগুনতি নেই। চাঁদকে ছুঁয়ে দিতে ইচ্ছে করার পাশাপাশি মানুষের চাঁদে যেতেও ইচ্ছে হয়েছে।

মানুষের এই ইচ্ছে পূরণ হয়েছে ১৯৬৯ সালের ২০ জুলাই। ন্যাশনাল অ্যারোনটিকস এড স্পেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন এর সংক্ষেপে নাম নাসা (NASA)। নাসাই প্রথম চাঁদের বুকে মানুষের পদচিহ্ন এঁকে দিয়েছে। ১৯৬৯ সাল থেকে শুরু হয়ে ১৯৭২ সালের মধ্যে মোট বারোজন নভোচারী চাঁদের বুকে হেঁটে বেড়িয়েছেন।

তাদের এইসব অ্যাডভেঞ্চারের কাহিনী আমরা প্রায়ই শুনি কিন্তু চাঁদের কোন গল্প আমরা তেমন একটা শুনতে পাই না। নাসার উৎক্ষেপিত মহাকাশযান অ্যাপোলোর নভোচারীরা চাঁদের বুক থেকে কিছু কেচ্ছাকাহিনী আমাদের জন্যে নিয়ে এসেছেন। এবার আমরা সেই কেচ্ছাই জানবো। নভোচারীরা চাঁদে পা রাখার আগে বিজ্ঞানীদের মনে নানারকম প্রশ্ন ছিলো। যেমন, চাঁদের বয়স কত? চাঁদ এসেছে কোত্থেকে ? চাঁদের বুকে অমন উজ্জ্বল আর কালো দাগ কে বানালো?
02

নভোচারীরা এসব প্রশ্নের উত্তর পাবার জন্যে চাঁদ থেকে প্রায় ৮৪০ পাউন্ড পাথর নিয়ে এসেছেন। সাথে তোলা ছবি আর অন্যান্য তথ্য তো আছেই। এসব থেকে বিজ্ঞানীরা তাদের প্রশ্নের উত্তর পেয়ে গেছেন।
03

চাঁদের উচুঁ ভূমি (উজ্জ্বল এলাকা) গুলোকে একসময় বিশাল বিশাল পাহাড় পর্বত বলা হলো এবং গোলাকার গর্তগুলোকে, বলা হতো আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখ। আসলে এই সব পাহাড় পর্বত আগ্নেয়গিরির কারণে তৈরি হয়নি। গ্রহাণু ও উল্কার সাথে ক্রমাগত চাঁদের সংঘর্ষের কারণে এসব তৈরি হয়েছে। চাঁদের জীবনকালের একটা সময় ওতে প্রচুর উল্কাপাত হয়েছে। উল্কাপাতের কারণে চাঁদের গায়ে তৈরি হয়েছে বিশাল বিশাল সব গোলাকার বাটির মতো গর্ত। চাঁদের নিজস্ব পাথর উল্কাপাতের কারণে ভেঙে টুকরো টুকরো হয়েছে। ওই একই জায়গায় পুণরায় উল্কাপাত যখন হয়েছে তখন ভাঙা টুকরোগুলো প্রচন্ড উত্তাপে গলে গিয়ে এক হয়ে তৈরি করেছে নতুন পাথর। বিজ্ঞানীরা এই সময়টার নাম দিয়েছেন ‘হেভি বম্বার্ডমেন্ট পিরিয়ড’। তাদের বক্তব্য হচ্ছে, এ সময় শেষ হয়েছে প্রায় চার বিলিয়ন বছর আগে। এই সময়ের বিষয়টা কিন্তু বিজ্ঞানীরা আন্দাজ করে বলেননি, চাঁদ থেকে আনা পাথর বিশ্লেষণ করেই তবে বলেছেন।
06
কালো সমতল ভূমিঃ
আমরা পৃথিবী থেকে চাঁদে যে কালো কালো ছোপ দেখি তা ইচ্ছে চাঁদের সমতল ভূমি। হেভি বম্বার্ডমেন্ট পিরিয়ডের একেবারে শেষের দিকে এই সমতল ভূমি সৃষ্টি প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। ঐ সময় গ্রহাণু বা উল্কার সাথে মারাত্মক সব সংঘর্ষ হয়েছিলো। এ সংঘর্ষের ফলে চাঁদের বুকে তৈরি হয়েছে বিশাল বিশাল সব গোলাকার ক্ষত। তখন চাঁদের একেবারে ভেতর থেকে বেরিয়ে এসেছে গলিত লাভা। এই গলিত লাভা চাঁদের বিশাল গোলাকার ক্ষত পূরণ করেছে গলিত, আগুনের লাভা একসময় শীতল হয়েছে এবং তৈরি হয়েছে সমতল ভূমি।
07
চাঁদ থেকে আনা বিভিন্ন পাথর বিজ্ঞানীদের মধ্যে কিন্তু বেশ বিভ্রান্তিও ছড়িয়েছে। চাঁদের উচুঁ ভূমি থেকে যেসব পাথর সংগ্রহ করা হয়েছে সেগুলো বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে যে, ওতে ফেল্ডস্পার নামের এক খনিজ পদার্থ পরিমাণে অসম্ভব রকম বেশি। ঠিক কী কারণে হালকা ধরণের এই খনিজ পাথরের উপরিভাগে এসে নিখুঁতভাবে জমা হয়েছে তা কিন্তু বিজ্ঞানীরা জানতে পারেননি। তবে তারা একটা ধারণা করে নিয়েছেন।

বিজ্ঞানীদের ধারণা মতে, হেভি বম্বার্ডমেন্ট পিরিয়ড শুরু হবার আগে পুরো চাঁদ গলিত পাথরের এক সমূদ্রে ঢাকা ছিলো। গলিত পাথরের সমুদ্র বিজ্ঞানীদের ভাষায় ‘ম্যাগমা সমুদ্র’। এই ম্যাগমা সমুদ্রের তারল্যের কারণে ফেল্ডস্পারের মতো হালকা খনিজ এসে উপরিভাগে জমা হয়েছে।

ম্যাগমা সমুদ্র যখন শীতল হয়ে জমে গেছে তখন ফেল্ডস্পার রয়ে গেছে উপরে। এ কারণেই চাঁদের ধূলোবালিতে ও পাথরের উপরিভাগে এর প্রাধান্য বেশি।

চাঁদের জন্মঃ
হেভি বম্বার্ডমেন্ট এবং ম্যাগমা সমুদ্র এই দুটি ধারণা প্রবর্তনের পর বিজ্ঞানীরা চাঁদের জন্ম প্রক্রিয়া সম্পর্কে ধারণা করতে পেরেছেন। চাঁদে অ্যাপোলোর মিশন শুরু হবার আগে চাঁদের পথপ্রক্রিয়া নিয়ে বিজ্ঞানীরা তিনটি পৃথক ধারণা দেবার চেষ্টা করেছিলেন। কোন ধারণাই চাঁদ সম্পর্কে উত্থাপিত সকল প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেনি। ধারণা তিনটি এরকমঃ
Untitled-1

১. চাঁদ ছিলো একটি ভবঘুরে গ্রহ। আমাদের সৌরজগতে সে বাউন্ডুলের মতো ঘোরাঘুরি করছিলো। সে পৃথিবীর পাশ দিয়ে যাবার সময় পৃথিবীর মহাকর্ষে আটকা পড়ে যায়।

কিন্তু এক্ষেত্রে প্রশ্ন থেকে যায় যে, পৃথিবীর মতো ছোট একটা গ্রহ কি চাঁদের মতো অতোবড় একটা জিনিসকে আটকে রাখতে পারে?

২. চাঁদ ও পৃথিবী একই ঘূর্ণায়মান পাথর ও ধুলোর মেঘ থেকে তৈরি হয়েছে।

এক্ষেত্রে সমস্যা হলো এই যে, একই যদি উৎস হবে, তাহলে চাঁদের পৃথিবীর মতো এতো ভরযুক্ত এবং গভীর অভ্যন্তরে দেশ নেই কেন?

৩. পৃথিবীর একটা অংশ বিচ্ছিন্ন হয়ে তৈরি হয়েছে চাঁদ। একটা অংশ বিচ্ছিন্ন হবার কারণ পৃথিবীর তীব্র ঘূর্ণনশক্তি।

মজার বিষয় হলো ঘূর্ণনশক্তির তীব্রতার কারণে যদি চাঁদের জন্ম হয় তবে পৃথিবীতে আজও সেই ঘূর্নণশক্তি থাকার কথা। তা কিন্তু নেই।

ভয়াবহ সংঘর্ষ তত্ত্বঃ
চাঁদের জন্ম সম্পর্কে চতুর্থ একটি তত্ত্ব দেয়া হয়। এই তত্ত্বানুযায়ী, পৃথিবী যখন বয়সে তরুণ তখন মঙ্গল গ্রহের আকারের একটি গ্রহাণু পৃথিবীকে আঘাত করে। এ আঘাতে আগন্তুক সেই গ্রহাণু পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যায় এবং মহাশূন্যে বিপুল ধূলোবালি উৎক্ষিপ্ত হয়। এর কিছু অংশ পৃথিবীর টানে পৃথিবীর চারপাশেই থেকে যায়। এবং পরবর্তীতে এসব মিলে তৈরি হয়েছে চাঁদ।

অ্যাপোলোর কার্যক্রম শুরু হবার পর ভয়াবহ সংঘর্ষ তত্ত্ব হালে পানি পাওয়া শুরু করে। হেভি বম্বার্ডমেন্টের কারণে যে গর্ত চাঁদে পাওয়া গেছে তা হয়তো একসময় পৃথিবীতেও ছিলো এবং পরবর্তী ভয়াবহ সংঘর্ষে চাঁদের ম্যাগমা সমুদ্র তৈরি হবার মতো তাপ উৎপন্ন হয়েছিলো। এবং এ সংঘর্ষ পৃথিবীকে তার অক্ষের উপর একটু বাঁকা হয়ে ঘূর্ণন গতি প্রদান করেছে। সেই মঙ্গল গ্রহের সমান জিনিসটার কিন্তু অংশ হয়ে গেছে। পৃথিবীর একাংশ এবং তাতে করে পৃথিবীর গভীর ও নিরেট অভ্যন্তরভাগ তৈরি হয়েছে। বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া চাঁদে এ ঘটনা ঘটেনি তাই চাঁদের ঘনত্ব কম।

অ্যাপোলোর কার্যক্রম চাঁদ সম্পর্কে আমাদের ভাবনা বদলাতে সাহায্য করেছে। আগে চাঁদ আমাদের কাছে ছিলো রহস্যময় এক জিনিস। আর এখন আমরা জানি, ওই চাঁদ একদিন পৃথিবীরই একটা অংশ ছিলো।

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান